সিবিএন ডেস্ক

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে প্রতিবছর জনগণের করের টাকা ব্যয় করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান থেকে বের হতে পারছে না। গেল অর্থবছরে ১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু গত বছরেই লোকসান দিয়েছে পাঁচ হাজার ১৪১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।  ২০১৭ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৬ সাল থেকে টানা ১১ বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে। একইভাবে ১৯৯০ সাল থেকে টানা লোকসান দিচ্ছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। টানা ২৬ বছরে একবারের জন্যও এই দুই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেনি। বিটিএমসি গতবছর এপ্রিল পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে ৩০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাত হাজার ৭৬১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে। গেল অর্থবছরে লোকসানের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসানি প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এই প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরের (এপ্রিল পর্যন্ত) লোকসান দিয়েছে ৯৭৫ কোটি তিন লাখ টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি। এসব লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে সততা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার অভাব। এ কারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাভে আসতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিবছর এই সব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি না দিয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে ভালো করবে।’

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, লোকসান দেওয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা (বিজেএমসি)। স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিও অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে আসছে। গত বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৫৩০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

এছাড়া ২০০৬ সাল থেকে টানা লোকসান গুনছে বিআরটিসি। এই প্রতিষ্ঠানটি গেল অর্থবছরে লোকসান গুনেছে ৮৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট (বিএফএফডব্লিউটি), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) টানা ১১ বছর ধরে লোকসান গুনছে। গেল অর্থবছরে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়েছে ৩৪ কোটি টাকারও বেশি।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান গুনছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। বিগত ১১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরমধ্যে গত অর্থবছরেই এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৪৪০ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

তবে দীর্ঘদিন লাভ করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) গত বছরে ২৭ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। একইভাবে দীর্ঘদিন লাভে থাকা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) লোকসান করেছে। গেল অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনেছে পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এছাড়া টানা দুই বছর লাভে থাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) গেল বছরে লোকসান গুনেছে। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৪৫৫ কোটি টাকারও বেশি। যদিও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা লাভ করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ২০১৪ সালের পরই দুর্নীতি, অনিয়ম ও একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লাভ কমে নেমে আসে ৯৩ কোটি ৪৪ লাখে। কিন্তু পরের অর্থবছর লোকসান হয় ৭৭ কোটি ৭৯ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের (এপ্রিল পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৪৫৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এছাড়া রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) লোকসান দিয়েছে ১৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। একইভাবে দীর্ঘদিন লাভে থাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি) গেল অর্থবছর লোকসান দিয়েছে। এ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনেছে ৫৯ লাখ টাকা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে নয়টি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সেবায় পাঁচটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সাতটি, কৃষি খাতে দু’টি, নির্মাণ খাতে পাঁচটি ও সেবা খাতে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।